expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Search This Blog

Saturday, May 23, 2015

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও কিছু চিরন্তন বাস্তবতা

সাধারণত বাংলাদেশ থেকে একজন শিক্ষার্থীকে আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনসহ ইউরোপ বা আমেরিকার যে কোনো দেশে পড়াশোনার জন্য আসতে হলে ছয় থেকে আট লাখ টাকার প্রয়োজন। আর যদি কোন দালাল-বাটপারের খপ্পরে পড়া হয়, তাহলে তো আম-ছালা দুটোই খুইয়ে ওখানেই ইতি। বাংলাদেশের সব প্রতিকূলতা জয় করে সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পা ফেলতেও সক্ষম হয়, তার অর্থ এই নয় যে পাতালপুরীর স্বর্ণের সন্ধান সে পেয়ে গেছে।
স্বজন ও বান্ধববিহীন প্রবাস জীবন যতটুকু আনন্দের, স্বপ্নের ও স্বর্গের মনে হয়, বাস্তবে কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও নেই। যাদের কপালে জুটেছে পরবাস, তারাই কেবল বোঝেন এর মর্মযাতনা।
ফিরে যাই মূল বিষয়ে। একজন শিক্ষার্থী যখন প্রবাসে এসে পৌঁছান তখন তিনি ওই পরিবেশের জন্য একেবারেই নতুন। ডান-বাম বলতে কিছুই বোঝে না। স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে কম করে হলেও দু-তিন মাস লেগে যায়। তাই যদি কেউ প্রবাসে পৌঁছেই মোটা টাকা কামিয়ে ফেলবেন বলে চোখেমুখে রঙিন স্বপ্ন মেখে বিদেশে পাড়ি দেন, তাদের সে আশা পূরণ হওয়া বেশ কঠিন।
দুনিয়া এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে। বেশি দিন আগে নয়, এই ২০০৮-এর দিকেও এখানকার ব্যাংকগুলো মানুষকে ডেকে ডেকে পারসোনাল লোন বা বাড়ি কেনার জন্য লাখ লাখ ইউরো (স্থানীয় মুদ্রা) মর্টগেজ হিসেবে দিত। এখন পরিস্থিতি এমন যে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দু-চার হাজার স্থানীয় মুদ্রা লোন পাওয়াটাই দুরুহ ব্যাপার। ব্যাংককে দোষ দিয়েই বা কী লাভ! তারা নিজেরাই দেউলিয়াপনায় ভুগছে।
অর্থনৈতিক অবস্থা যখন এতটাই মন্দা, তখন চাকরির বাজার তো রমরমা হতে পারে না। ক বছর আগে যে ছাত্ররা সপ্তাহে বিশ (সামারের ছুটি ছাড়া সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা কাজ করার বৈধ নিয়ম) ঘণ্টার স্থলে ষাট থেকে আশি ঘণ্টা কাজ করত, তাদের এখন দিন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। স্মার্ট কৌশলে যারা আগেই নিজেদের ‘স্টুডেন্ট স্ট্যাটাস’ বদলে স্থায়ী রেসিডেন্সি নামের সোনার হরিণটির নাগাল পেয়ে গাছেন তাদের কথা আলাদা। চাকরি থাক বা না থাক, সরকারি ভাতা খাওয়ার মুখ তো তাদের আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু ছাত্রই নয়, যারা স্থায়ী কর্মজীবী তারাও যদি কোনো কারণে চাকরি হারিয়ে বসেন, নতুন আরেকটি কাজ পাওয়া যেন হাতির দাঁত পাওয়ার মতো অবস্থা।
কিছুদিন আগে স্পেনে ভ্রমণকারী এক বাংলাদেশি সাংবাদিক ঢাকার একটি জাতীয় পত্রিকায় ওখানকার সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, সেখানে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩৫%। এমন অবস্থা শুধু আয়ারল্যান্ড বা স্পেনে নয়, ইউরোপসহ পুরো বিশ্বের বর্তমান চিত্রই অভিন্ন।
বিদেশে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আগেই ভাবতে হবে, তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে যাচ্ছেন, নাকি টাকা কামাই করতে। নাকি দুটোই! কপাল ভালো হলে কোনো রকমে একটি পার্টটাইম জব জুটিয়ে নিতে পারলে অন্তত খেয়েপরে থাকা যাবে। আয়ারল্যান্ড বা এর আশপাশের (যেহেতু আমি আয়ারল্যান্ডে বাস করি, তাই আয়ারল্যান্ডের কথা বার বার চলে আসছে, এজন্য দুঃখিত ) দেশগুলোতে একজন লোককে মোটামুটিভাবে চলতে হলেও ন্যূনতম পাঁচ-ছয়শ স্থানীয় মুদ্রার প্রয়োজন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকার সমমান। তাও এ অঙ্কটা শুধু তাদের জন্যই, যারা চা-সিগারেটের মতো বদভ্যাস থেকে মুক্ত। এছাড়া আছে কলেজ ফিসহ আরো টুকিটাকি আনুষঙ্গিক খরচ। সুতরাং বর্তমানে এ অসুস্থ অর্থনৈতিক পরিবেশে কোনো শিক্ষার্থী ‘কলাও বেচবেন, রথও দেখবেন’ মনোভাব নিয়ে প্রবাসে এলে তা হবে এক চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
অর্থনৈতিক হিসেব-নিকেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। কেউ যদি হোটেল-রেস্টুরেন্টের কিচেনে দাঁড়িয়ে থালাবাসন ধোয়া কিংবা পেঁয়াজ কাটার মতো কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে কিছু টাকাপয়সা আয় করে পড়াশোনা চালাতে পারেন তবে তা ভালো। প্রকৃত অর্থে যারা উচ্চশিক্ষার্থে প্রবাসমুখী হন, তাদের পক্ষে আয়রুজি করা সম্ভব না হলেও দেশ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা সম্পন্ন করবেন সন্দেহ নেই। এই যে কায়িক পরিশ্রম অথবা দেশ থেকে কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে এনে যদি কাক্সিক্ষত সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া না যায় এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কী-ই বা হতে পারে!
একটু খুলেই বলি। যারা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশের পথে পা বাড়ান তারা কি আদৌ জানেন কোথায় যাচ্ছেন, কী পড়ছেন, কী শিখছেন? কারা পড়ান? পড়া শেষে আদৌ কি কোনো ডিগ্রি পাওয়া যায়? দেশ থেকে বেরুনোর আগেই এ বিষয়গুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ থেকে যেসব ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমন করেন তাদের সিংহভাগই কোনো বিশ্ববিদ্যলয়ে যান না। বরং ওরা কোনো কলেজে ভর্তি হন বা হওয়ার চেষ্টা করেন। যেসব কলেজে ভর্তি হয়ে তারা পড়াশোনা করেন, এগুলোর অধিকাংশই বেসরকারি মালিকানাধীন। ওই মালিকরা বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেনের ব্যবসায়ী মালিকদের মতই অনেকটা। বিভিন্ন দেশের মালিকদের মতো বাংলাদেশি মালিকরাও এ ব্যবসার সাথে জড়িত। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনেও আছেন এ ধরনের একজন ব্যবসায়ী মালিক।
মূলত এসব কলেজের অধিকাংশেরই কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকে না। দু-তিনটি রুম ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। একটা প্রতিষ্ঠানে যে কজন শিক্ষক থাকেন তাদের মধ্যে একজনকে পাওয়া যাবে ফুলটাইমার হিসেবে। এসব কলেজ খোলার জন্য আহামরি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। স্থানীয় প্রশাসন থেকে যৎসামান্য একটা ফি দিয়ে সনদ আদায় করতে পারলেই কেল্লা ফতে। এই কলেজগুলো তিন-চার বছর পর একটি ডিগ্রিও দিতে পারে না। একটা সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা পাওয়া যায়, যা কিনা আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় একেবারেই নগণ্য। তখন একূল-ওকূল দু কুল হারিয়ে নৈরাশ্যের সাগরে হাবুডুবু খেতে হয় অনেককেই।
তাই ঊচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক তরুণ শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, হরিপদ কেরানি থেকে আকবর বাদশাহ হয়ে যাবার স্বপ্নে বিভোর না থেকে বাস্তব প্রতিকূল দিকগুলোর কথা বিবেচনায় এনে তবেই সামনের দিকে এগোবেন। এতে আপনাদের জন্য, পরিবারের জন্য তথা জাতির জন্য হবে শুভ ও মঙ্গল।
Google PageRank Checker Powered by  MyPagerank.Net Valid CSS! Creative Commons License

Public Domain Mark

CC0